চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো......

বেলার তিন বছরের সংসারে যেন এগারোটা মাস ধরে নতুন এক স্বর্গের হাওয়া এসে লেগেছে, এক নূর এসে আলোকিত করেছে পুরো বাড়ি... এগারো মাসের ফুটুফুটে বাচ্চাটার দিকে তাকালে দুনিয়া ভুলে যাওয়া যায় অতি সহজেই....
ক'দিন হল নতুন এক সমস্যা.... কান্না শুরু করলে থামতে চায়না.... হয় বাইরে নয়তো ছাদে নিয়ে পায়েচারি করার পর কিছুটা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এছাড়া থামাবার উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি....
ঠিক যেমন আবিষ্কৃত হয়নি ক্যাপ্টেন ফুয়াদের গতিরোধ করার উপায়।
৮০ তম বিএমএ লং কোর্সের তুখাড় ক্যাডেট ফুয়াদ আজ টাইগার্স ডেন খ্যাত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো অফিসার, দুদ্ধর্ষ অফিসার সে। চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে সিয়েরা লিওনের বিদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই একটা নামেই বড় বেশি হতাশ হয়ে পড়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে সে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র, যেন পরাজয়ের সঙ্গা তার জানা নাই, সে যেন পিছু হটতে জানেনা। মুদ্রার অপর পিঠ ও রয়েছে তেমন... তাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই এই নরম সরম মানুষটা কি করে এত হিংস্র হয়ে ওঠে... ইউনিটে সবার প্রিয় আর আদিবাসী ভুক্তভোগীদের ভরসার পাত্র ক্যাপ্টেন ফুয়াদকে পিস মিশনে একবার এক বিদেশী সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিল আপনি যেমন বুক দিয়ে এখানকার মানুষদের আগলে রাখেন এই আদিবাসীরা ও তেমনি আপনাকে বুকের মধ্যে ধারণ করে... এই যে সবার মনের মধ্যে আপনি আছেন আপনার কেমন লাগে বিষয়টা....
এক সময়ের তুখাড় বিতার্কিক ফুয়াদ যেন একটা প্রশ্নেই থমকে যায়.... সত্যিই কি সে সবার মনের মধ্যে আছে..???
আন্তঃ কলেজ বিতর্কের বিভাগীয় পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের বিপক্ষে বরেন্দ্র কলেজের হয়ে কড়া যুক্তি প্রদর্শন করলো বেলা
প্রতিপক্ষ দলের ফুয়াদ দাঁড়িয়েই বলেছিল " মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা দেখতে যতটা সুন্দর তার স্পিচ ততটা সাবলীল ছিল..?? আমার মনে হয়না "
এই প্রথম বেলার নজরে আসলো ফুয়াদ.... বেলা মেয়েটা দেখতে আসলেও সিম্পলি অসাধারণ।  ফুয়াদ সেবারই বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করলো মেয়েটা সাধারণের মধ্যেও কেমন অসাধারণত্ব ধারণ করে নিজের মধ্যে। যেন সব আকর্ষণের অধিকারিণী সে একাইই....
সে যাই হোক সেবার একই রাউন্ডে পরের টাতে ফুয়াদ নিজের ডিবেট বাদ দিয়ে মেয়েটার ডিবেট দেখতে বসে গেল....
বেলার নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা, বক্তব্য পেশ করার এক পর্যায়ে বার দুয়েক ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসেছিল বেলা। একটা বরফ গলতে বোধ হয় এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন ছিলোনা....
এরপর যোগাযোগ, ফেসবুক....।
শুধুই বন্ধুত্ব। মাঝে ছয়মাস কোনো যোগাযোগ ও ছিলোনা
তবু সব বন্ধুকে তুই বললেও বেলা ফুয়াদকে তুই বলতে পারতোনা কেন জানি।তুইটা আসতোনা ফুয়াদের প্রতি।
অনেক কথা বলতে ভালো লাগতো। এমনকি সারাদিন কথা বলতে ভালো লাগতো। অগত্যাই সে ফুয়াদের কথা শুনে ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নিজের সব ছবি সরিয়ে ফেললো। কেন জানি ফেলতে পারেনা ফুয়াদের কথা। রাত জেগে কথা বলতে ফুয়াদের তো বেশ লাগতো। ইচ্ছা করেই সে ঘুমাতে দিতোনা বেলাকে।
" ফুয়াদ আমার না অনেক পড়তে হবে, আজ রাখি "
- রাখবা???  না আমি রাখতে দিবোনা। তুমি পড়তে পারবেনা
- উঁহু উঁহু :'( :'(
এই কিউট আহ্লাদী কান্নাটার প্রতি ফুয়াদ একটু বেশিই দুর্বল
সময়টা বেশ কল্পনার মতই কাটে
ও হ্যাঁ ফুয়াদের আম্মুকে আম্মু ডাকতো বেলা। ফুয়াদ ও বেলার আম্মু কে আম্মু বলতো....
" ফুয়াদ আমার খুব ভিজতে ইচ্ছা করতেছে তোমার ভেজা দেখে "
সিএনজির মধ্যে বসে ফুয়াদকে ফোনে বলে বেলা বড় আদুরে গলায়...
ফুয়াদ তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসে আর বেলাকে দেখে
বেলার খুব রাগ হয়
সে আবার বলে ওঠে এভাবে না ভিজে দ্রুত বাসায় চলে যেতে
ফুয়াদ এর তাতে আরো হাসি পায়....
আজও বৃষ্টি দেখলে ১০ বছর আগের কথা মনে পড়ে বেলার.... কেমনে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে.
বেলা মেয়েটা বেশ সংসারী।  স্বামী সন্তান আর শখের অরফ্যান হোম নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় পার করে সে।চট্টগ্রামের হিল ট্র‍্যাকের মানুষগুলো তাকে মন থেকেই শ্রদ্ধা করে। হাজারটা বাচ্চার মা সে। এ দায়িত্ব যে কতটা সাহসের তা বোধ করা বড় কঠিন।
আজ ও সে বিকেলে বৃষ্টির মধ্যে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিল দ্রুত। স্বামীর অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে এল যে...
হঠাৎ রাস্তার ধারে এক পাহাড়ী কিশোর নিজে ভিজে এক কিশোরীর মাথায় ছাতা ধরে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে যায়। সে কিশোরীর চোখের ভাষা পড়তে পারে বেলা। নিখাদ ভালোবাসা আর বুক ভরা ভরসা দেখতে পায় স্পষ্টই। সেই থেকেই মনটা বড় খারাপ।
বেলা প্রায়ই ফুয়াদকে বলতো সে কখনো প্রেম ও করবেনা বিয়েও করবেনা।
ফুয়াদ ও তাই সাহস পেতোনা কিছু বলতে,বন্ধুত্বটা ভেঙ্গে যাবে বলে....
অথচ দুজনেই দুজনকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছে। বেলা অন্তর্দ্বন্দে ভুগতো। সে চাইতো না ফুয়াদের উপর দুর্বল হোক আবার সে এটাও মানতে পারবেনা ফুয়াদ অন্যকারো হোক।
সবে ৮০ তম বিএমএ লং কোর্সের সার্কুলার দিবে ফুয়াদ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে বেলাকে বলেই ফেলে ভালোবাসি..........
নিজের ইগোর সাথে যুদ্ধে হেরে যায় বেলা.... এই বয়সের ইগো বড় ভয়ংকর জিনিস... এর আগেও অনেককিছুই হারাতে হয়েছে তাকে ইগোর সাথে হেরে.... সবই বুঝতে পারে বেলা,তবু যেন অসহায়।এবারের ক্ষত যেন মোছা বড় কঠিন।
তারপর আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি কারো।
আসতে আসতে ডায়াল লিস্টের নাম্বারটার স্থায়ী ঠিকানা হয় ব্লকলিস্ট।
ইনবক্সের নীল নামের পাশে আর কখনো সবুজ বাতি জলেনি, রঙ টাও কেমন যেন নীল থেকে কালো হয়ে যায়....
ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফুয়াদ, ব্যস্ত হয়ে পড়ে বেলা।
আইএসএসবিতে গ্রিন কার্ড পেয়ে " চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো" গাওয়া হয়নি ফুয়াদের....
ফুয়াদের ইনোসেন্ট হাসিটা আর দেখা হয়নি বেলার....

.
পেরিয়ে গেছে দশটা বছর....
ক্যাম্পে বসে সবে দুপুরের খাবার খেয়েছে এরই মধ্যে মায়ের ফোন
" কি করিস বাবা???
- এইতো আম্মু খাওয়া দাওয়া করলাম
= ওখানে আজ শীত কেমন???
- না আম্মু তেমন শীত নাই, আব্বু কি করে??
= তোর আব্বু তো একটু বাইরে গেছে আসবে একটুপর
- ও... তুমি কেমন আছো আম্মু??
= তুই আসবি কবে???
- হা হা হা হা আসবো আম্মু আসবো
= এবার কিন্তু একটা লাল টুকটুকে বউ ঘরে আনবো
- ধুর আম্মু কি যে বলোনা!
আমার কাজে আছে রাখি!
= হা হা হা হা পাগল ছেলে। সাবধানে থাকিস
ফোন রেখে ফুয়াদের মনে পড়ে হঠাৎ
আচ্ছা বেলা কি বিয়ে করেছে..?? ও তো বলেছিল কখনো বিয়ে করবেনা...
আচ্ছা ও কি এখন অন্যকারো সাথে কথা বলার সময় মিষ্টি করে কাঁদে???  ও কি অন্যকারো সাথে বৃষ্টিতে ভেজে...???
ওদিকে ফুয়াদের ডাক পড়ে মেজর রফিকের অফিসে দ্রুত.... সে বেরিয়ে পড়ে....

আজ রাতে আকাশে অনেক তারা ঝলমল করে আর একটা চাঁদ.... বাচ্চাটা অনেক কান্নাকাটি করার পর কেবল ঘুমোলো। বাচ্চা কোলে নিয়ে পায়েচারি করতে করতে ক্লান্ত বেলা নিচে নামতে যাবে ছাদ থেকে, হঠাৎ মনে পড়ে সে রাতেও এমন জোছনা ছিল.... যে রাতে নিজের ইগোর সাথে হেরে ভালোবাসি কথাটা স্বীকার করতে পারেনি বেলা ফিরিয়ে দিয়েছিল ফুয়াদকে। কিছুটা রাগ ও হয়েছিল ফুয়াদের উপর, সব জেনেও কেন জিজ্ঞেস করতে হবে...???
তার ছোট্ট বাচ্চাটার মতই চোখের পানি ফেলেছিল সে রাতে বেলা, ঐ উপন্যাসের মত চাঁদ তারা ছাড়া সে জ্বলের সাক্ষী আর কেউ ছিলোনা, কেউ না। বেলার অনেক জেদ ছিল ফুয়াদকে ভুলে যাবে। সে ভাবে সে সত্যিই ভুলে গেছে ফুয়াদকে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নিঠুর... আজ সে অন্যের বউ। তবু বৃষ্টির পানি, বাচ্চার কান্না, জোড়া ছেলেমেয়ে, টেলিভিশন বিতর্ক সব কিছু যেন শুধু ফুয়াদের চেহারায় তাকে বারবার মনে করায়, বারবার। ভাবে সেদিন যদি সব ভুলে একবার মুখ ফুটে হ্যাঁ বলে দিত ওভাবে বুকে পাথর চেপে কড়া কথা না বলে..... আজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়া যেন কিছুই করার নেই, পেরিয়ে গেছে এক দশক। আচ্ছা ফুয়াদ এখন কোথায় আছে..???  বিয়ে করে নিয়েছে..??? সেই মেয়ে কি আমারর চেয়েও সুন্দরী..??? অনেক বেশি সুখে রাখে বোধ হয় ওকে... আচ্ছা এই চাঁদ কি ওরা এক সাথে বসে দেখছে...???
চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়.... তার মনে পড়ে সে বলেছিল কখনো বিয়েই করবেনা, অথচ সেদিনের বেলা আজ ভরপুর সংসারী,  বড় ইচ্ছা করে সেদিনগুলোতে ফিরে যেতে, আজ বুঝতে পারে সেদিনের মিথ্যে ক্রোধ,  মরীচিকার মত ইগো তার কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছে.....
যাহ কি সব ভাবছি আমি!!  আমি না ঐ লোকটার বাচ্চার মা!  না না না এসব ভাবা আমার শোভা পায়না। চোখটা মুছে ফেলে বেলা। ভাবে ফুয়াদকে কি একবার ফোন দেবে সে????
 নয় হাজার মাইল দূরে সিয়েরা লিওনে এত কিছু ভাবার অবকাশ নেই ক্যাপ্টেন ফুয়াদের... আর্জেন্ট কল অতর্কিত হামলা করেছে কোন এক নিরাপত্তা চৌকিতে দুষ্কৃতিকারীরা, প্লাটুন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যাপ্টেন ফুয়াদ..... মা কে ফোন দিয়ে দোয়া নেয় প্রত্যেকবার, সাথে লুকিয়ে মানিব্যাগে কার একটা ছবিতে চুমু খেয়ে মন দেয় অপারেশন প্ল্যানে......
সময় এগিয়ে যায়, বেলার রাত বাড়ে, পুরোনো রাত..... ৯০০০ মাইল দূরে বিকেল.... সব কিছুর পার্থক্যের মাঝেও আবেগে সেই আগের মিল..... এভাবেই বেঁচে থাকে হাজারো ভালোবাসা.... মানুষ বদলাতে জানে, সময় পাল্টাতে জানে, সম্পর্ক ভাঙ্গতে জানে কিন্তু ভালোবাসা হারায়না কোনদিন.... আগের মতই থেকে যায় ঠিক আগেরই মত....

মন্তব্যসমূহ

  1. Blackjack and Roulette Online - JTM Hub
    Online blackjack with 춘천 출장샵 the best gameplay 세종특별자치 출장안마 from casino players. You can play it on 김천 출장샵 mobile 밀양 출장샵 and desktop! With jackpot bonuses, Payouts: 0.2 to 1.5 전라북도 출장샵 billion, 0.0 to 1 billionMin. Deposit: 25

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আহবান

ফরেস্ট গ্রিন